Header Ads

সোভিয়েত রাশিয়ার রুবল


 

১৯৯১ সাল পর্যন্ত বর্তমান রাশিয়াকে বলা হত সোভিয়েত রাশিয়া। পুরো নাম ছিল ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক। ছোট করে ইউএসএসআর (CCCP) সোভিয়েত রুবল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মুদ্রা। ১০০ কোপেক = রুবল I সোভিয়েত রুবল বিশ্বে শক্তিশালী মুদ্রাগুলির মধ্যে অন্যতম এক মুদ্রা ছিল। ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত মূল্যে সোভিয়েত রুবল = পাউন্ড স্টার্লিং সমান। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে সঙ্গেই সোভিয়েত রুবল- গরিমা হারালো I



 

ঠান্ডা যুদ্ধে (Cold War) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়ে ১৫ টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো I

সেগুলি হলো আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্থান, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলডোভা, রাশিয়া, তাজিকিস্তান,তুর্কমেনিসস্তান , ইউক্রেন এবং উজবেকিস্তান I ১৯৬১-৯১ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যেকটি নোটের পেছনে রুবল কথাটি ১৫ টি প্রজাতন্ত্রের ভাষায় লেখা হতো I

 


সোভিয়েত অর্থনীতি ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। ভূমি বাড়ির ব্যক্তিগত মালিকানা সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত হতো কার্ল মার্ক্স ভ্লাদিমির লেনিনের দর্শনানুসারে। রাষ্ট্রের নাগরিকরা বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা লাভ করতো। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত সবাই বিনামূল্যে শিক্ষা পেতো। জল , গ্যাস, সেন্ট্রাল হিটিংসহ নাগরিক বিভিন্ন সুবিধায় রাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান করায় নাগরিকদের খাতে তেমন কোনো খরচ করতে হতো না। পেশা চাকরির শর্তানুসারে বেতন নির্ধারিত হতো। ছাত্রদেরও রাষ্ট্র বেতন প্রদান করতো। সব চাকরিজীবীকে ডরমিটরিতে আবাসন প্রদান করা হতো। পরবর্তীতে সবাইকেই নিজস্ব বাড়ী প্রদান করা হতো। খুব অল্প কিছু বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন লোককে জীবনের শুরুতেই বড় অ্যাপার্টমেন্ট প্রদান করা হতো। মূলত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ছিল সোভিয়েত সমাজের বৃহত্তর অংশ।

 


১৯৬১ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাংকনোটের সম্মুখে থাকতো ভ্লাদিমির লেনিনের ছবি যিনি ছিলেন রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বলশেভিক বিপ্লবের নেতা এবং সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রথম প্রধান। তার শাসনের অধীনে রাশিয়ায় বৃহত্তর সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত একদলীয় সাম্যবাদী রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় তার পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লবে অত্যাচারী স্বৈরশাসক রোমানভ রাজবংশের সমাপ্তি এবং রাশিয়ায়  সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটে।



 

সোভিয়েত রাশিয়ার ব্যাংকনোটের পেছনে মস্কো ক্রেমলিনের ছবি থাকতো I ক্রেমলিন,যা কিনা রাশিয়ার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান, তেরো শতক থেকে শুরু করে রাশিয়ার সকল ঐতিহাসিক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে জড়িত। মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ক্রেমলিনের স্থাপত্যকলা শৈল্পিক সৌন্দর্য যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। ঐতিহাসিক দুর্গ ঘেরা এই ক্রেমলিন কমপ্লেক্স রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এর দক্ষিণ দিকে মস্কোভা নদী, উত্তরে সেন্ট ব্যাসিল ব্যাসিলিকা (একটি ক্যাথেড্রাল), পূর্বে রেড স্কয়ার এবং পশ্চিমে রয়েছেদ্য আলেক্সান্ডার গার্ডেন



 

অধিকাংশ মানুষ ক্রেমলিনকে একটি ভবন ভেবে ভুল করে থাকেন। মূলত ক্রেমলিন বিশাল জায়গা জুড়ে একাধিক নান্দনিক টাওয়ার, ক্যাথেড্রাল এবং চার্চের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমপ্লেক্স। বর্তমানে রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের বাসভবন ক্রেমলিন একসময় জারদেরও বাসভবন ছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাশিয়ান নেতা ক্রেমলিনের সংস্কার করেছেন নিজেদের মতো করে। রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথেরিন, যিনিক্যাথেরিন দ্য গ্রেটনামেও পরিচিত, বেশ কয়েকটি চার্চ ভেঙে ফেলেন এবং সেই স্থানে নির্মাণ করেন নিজের দৃষ্টিনন্দন বাসভবনক্যাথেরিন প্রাসাদ জার প্রথম নিকোলাস তো পুরোউইন্টার প্যালেস ভেঙে ফেলেছিলেন, যদিও তা পরে পুননির্মাণ করা হয়। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ান সমাজে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, তার প্রভাব ক্রেমলিনেও পড়েছিল। সে সময় ভ্লাদিমির লেনিন তার বাসভবন ক্রেমলিনের সিনেট ভবনে স্থাপন করেন। আর পুরো ক্রেমলিনকে দৃষ্টিনন্দনক্রেমলিন স্টারদিয়ে সজ্জিত করেন স্ট্যালিন।স্ট্যালিন জারদের শাসনামলের সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি অনেক নিদর্শন ধ্বংস করে ফেলেন এবং টাওয়ারগুলোর উপরেরগোল্ডেন জারিস্ট ঈগলসরিয়েসাইনিং সোভিয়েত স্টারসস্থাপন করেন। সময় থেকেই ক্রেমলিন হয়ে ওঠে সোভিয়েত রাশিয়ার সকল ক্ষমতার উৎস নিদর্শন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ক্রেমলিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯০ সালে ক্রেমলিন ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।



 

আবার ফিরে আসি ইতিহাসে I একদা একসময় রাশিয়ার জার-সাম্রাজ্য ছিল অত্যন্ত নিপীড়নমূলক এবং সাধারণ জনগণ তাতে অত্যাচারিত এবং নিষ্পেষিত হতো। অবশেষে রাশিয়াতে জারবিরোধী মার্ক্সবাদী রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি গঠিত হয়। ১৯০৩ সালে এই দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি দলের নাম বলশেভিক পার্টি এবং অপরটির নাম মেনশেভিক পার্টি। একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় প্রথম দলটির নাম হয় বলশেভিক কারণ বলশেভিক অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অপরদিকে মেনশেভিক অর্থ সংখ্যালঘুতা।



 

বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন। ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর সেন্ট পিটার্সবার্গে সংঘটিত হয় একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান। ঐতিহাসিক অবস্থানকে অক্টোবর বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়, তবে নভেম্বর বিপ্লব কিংবা বলশেভিক বিপ্লব নামেও পরিচিত। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণী। তারা হাত মিলিয়েছিলেন গরীব কৃষকদের সাথে। ঐদিন সন্ধ্যায় তৎকালীন রুশ বুর্জোয়া সরকারের শেষ ঘাঁটি শীত প্রাসাদের উপর বিজয়ী আক্রমণ চালায় বিপ্লবীরা। ওই সময় জরুরী অধিবেশনে ভ্লাদিমির লেনিন জানান,"যে শ্রমিক কৃষক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা বলশেভিকরা সর্বদা বলে এসেছে তাই ঘটলো।"অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয় এর ফলে একচেটিয়া পুঁজিবাদ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার কবল থেকে মুক্তি পায় বিশ্বের এক ষষ্ঠাংশ ব্যাপী বিস্তৃত বিশাল একটি দেশের জনগণ। রাশিয়া বিশ্বের চোখে হয়ে ওঠে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর একটি রাষ্ট্র। এই বিপ্লবকে সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি সমমনা অঞ্চল গুলোকে একইভূত করে ১৯১৮ তে সৃষ্টি হয় সোভিয়েত ঐক্য। লেনিন ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি, মস্কোর কাছে গোর্কি লেনিনস্কিয়েতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫৩ বছর।



 

১৯৯১ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বিশ্বের সর্বপ্রথম এবং একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতন ঘটে। লেনিনের স্বপ্ন ছিল মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করার। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিলুপ্তির মাধ্যমে তার সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।

 


No comments

Powered by Blogger.